free tracking

My Blog

My WordPress Blog

স্বর্ণের দাম যত হতে পারে চলতি বছরের শেষ দিকে!

চলতি বছরের শুরু থেকেই অস্থির স্বর্ণের বাজার। যার প্রভাবে প্রথম চার মাসেই দাম সমন্বয় হয়েছে ২৬ বার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা বজায় থাকলে দাম সমন্বয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হতে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতি এখন এক অস্বস্তিকর সমীকরণে আটকে আছে। মূল্যস্ফীতির চাপ, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, ডলারের দামের ওঠানামা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ সব মিলিয়ে বাজারজুড়ে অনিশ্চয়তা। এই পটভূমিতে স্বর্ণ আবারও উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

এর প্রভাবে চলতি বছরের শুরু থেকেই অস্থির স্বর্ণের বিশ্ববাজার। বর্তমানে স্বর্ণের প্রতি আউন্স দাম ৩২৮০ থেকে ৩৩৫০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করলেও সম্প্রতি এটি ছুঁয়েছিল রেকর্ড ৩ হাজার ৫০০ ডলারের মাইলফলক। বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস সম্প্রতি পূর্বাভাস দিয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে চলতি বছরের শেষ দিকে স্বর্ণের দাম ৩ হাজার ৭০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। একইসঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান বলেছে, স্বর্ণ এখন শুধু নিরাপদ নয়, বরং লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারীই নয়, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ কিনেছে। এই প্রবণতা ২০২৫ সালেও অব্যাহত আছে।

বিশেষ করে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবিরতভাবে স্বর্ণ কিনছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন এখন মার্কিন ডলার নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে চায়। তারা স্বর্ণে রিজার্ভ বাড়িয়ে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিকল্প ভিত্তি তৈরি করতে চায়।

এই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রহের ফলে স্বর্ণের বাজারে যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে এর দামে ঊর্ধ্বমুখী চাপ বজায় রাখবে।

মূলত চলতি বছরের শুরু থেকে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ, বিশ্ববাণিজ্যে হৈচৈ ফেলে দেয়া কিছু সিদ্ধান্ত ও বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ মজুতের প্রবণতায় অস্থির হয়ে ওঠে স্বর্ণের বাজার। যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারেও।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম সমন্বয় হয়েছে মোট ২৬ বার। যার মধ্যে দাম বেড়েছে ১৯ বার, বিপরীতে কমেছে মাত্র ৭ বার। আর গত বছরের একই সময়ে মোট দাম সমন্বয় হয়েছিল মাত্র ১৭ বার।

চলতি বছর দাম সমন্বয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল বৃদ্ধির মাধ্যমেই। গত ১৫ জানুয়ারি ভরিতে ১ হাজার ১৫৫ টাকা বাড়িয়ে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৩ টাকায়। এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ৭ দফায় বাড়ানো হয় স্বর্ণের দাম। যার মধ্যে গত ১, ৬, ১০, ১৭ ও ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতিবারই রেকর্ড ভেঙে দাম গড়েছে নতুন ইতিহাস। ২০ ফেব্রুয়ারি স্বর্ণের দাম দাঁড়ায় রেকর্ড ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৫ টাকায়।

তবে গত ২৩ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ১ মার্চ টানা ৩ দফায় কমানো হয় স্বর্ণের দাম। ৩ দফায় ভরিতে ৬ হাজার ১৮২ টাকা কমে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৩ টাকায়। এরপর গত ৪ মার্চ ভরিতে ৩ হাজার ৫৫৭ টাকা বাড়ানো হলেও গত ৮ মার্চ কমানো হয় ১ হাজার ৩৮ টাকা। দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৬২ টাকায়। তবে গত ১৬, ১৮, ২৫ ও ২৮ মার্চ টানা ৪ দফায় মোট ৭ হাজার ১০ বেড়ে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের ভরি গিয়ে ঠেকে রেকর্ড ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৭২ টাকায়।

আর সবশেষ এপ্রিল মাসের শুরুটা হয় দামের পতনের মধ্য দিয়ে। গত ৮ এপ্রিল ভরিতে ১ হাজার ২৪৮ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৪ টাকা। তবে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ভরিতে বাড়ানো হয় ২ হাজার ৪০৩ টাকা। দাম গিয়ে ঠেকে রেকর্ড ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭ টাকায়।

এর ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে স্বর্ণের দামে বড় লাফ দেখে দেশবাসী। ভরিতে ৪ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়িয়ে ২২ ক্যারেটের এক ভরির দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ১৬৩ হাজার ২১৪ টাকা। তবে পরদিনই ভরিতে ১ হাজার ৩৮ টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৬২ হাজার ১৭৬ টাকা।

এরপর টানা ৪ দফায় মোট ১৫ হাজার ৭১২ টাকা স্বর্ণের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাজুস। গত ১৬, ১৯, ২১ ও ২২ এপ্রিল টানা ৪ দফায় দেশের বাজারে বাড়ে স্বর্ণের দাম। প্রতিবারেই রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়ে স্বর্ণের দাম।

তবে সবশেষ গত ২৩ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে স্বর্ণের দামে বড় পতন ঘটে। সেদিন ভরিতে কমানো হয় ৫ হাজার ৩৪২ টাকা। ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরির দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা। এছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৮০ টাকায়। বর্তমানে এই দামেই দেশের বাজারে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে।

বাজুস বলছে, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশেও দাম সমন্বয়ের প্রয়োজন পড়ে। না হলে স্বর্ণ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিংয়ের চেয়ারম্যান ও বাজুস সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঠানামা করে স্বর্ণের দাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বাজারেও দাম সমন্বয়ের প্রয়োজন পড়ে।

তবে স্বর্ণের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে ৭০-৮০ শতাংশ বেচাকেনা কমে গেছে বলেও জানান তিনি। মাসুদুর রহমান বলেন, দাম বাড়ায় সব দেশেই বেচাবিক্রি কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুদিন ধরেই স্বর্ণ ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে পরিচিত, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটিকে অনেকে ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবেও দেখছেন। কারণ এর চাহিদা যেমন স্থিতিশীল, তেমনি মূল্যও দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এই বাজারেও ঝুঁকি আছে। যদি হঠাৎ করে বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যায়, বা যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, তাহলে স্বর্ণের দামে হঠাৎ পতন ঘটতেও পারে।

বিশ্বখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৬ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের মধ্যেই স্বর্ণের দাম ছাড়িয়ে যেতে পারে প্রতি আউন্সে ৪ হাজার ডলার।

জেপি মরগানের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চলতি বছর প্রতি প্রান্তিকে গড় স্বর্ণ চাহিদা থাকতে পারে প্রায় ৭১০ টন, যা দামের ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রাখতে সহায়ক। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ স্বর্ণের গড় দাম হতে পারে ৩ হাজার ৬৭৫ ডলার। তবে বাজার পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে আরও আগেই।

আর বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী জন পলসন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ২০২৮ সালের মধ্যে স্বর্ণের দাম প্রায় প্রতি আউন্স ৫ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রয় এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে সম্ভব হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *