বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিগত সময়ের ঘটনাপ্রবাহ থেকে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, খেলোয়াড়দের বিদায় কিংবা তাদের ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-এর ভূমিকা অনেক সময়ই বিতর্কিত থেকেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান পাঁচ স্তম্ভ, যাদের আমরা “পঞ্চপাণ্ডব” বলে চিনি—মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, এবং মাহমুদউল্লাহ—তাদের বিদায় কিংবা নানা সংকটময় পরিস্থিতি নানা ইস্যুতে ঘিরে থেকেছে।
পঞ্চপাণ্ডবের অবদান ও তাদের প্রেক্ষাপট২০০৭ সালের বিশ্বকাপের পর থেকেই মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। এই পাঁচ ক্রিকেটার ব্যাটিং, বোলিং এবং দলীয় নেতৃত্বে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে দলকে এক পরিণত রূপ দেন। দলকে ধারাবাহিক জয়ের অভ্যাসে আনার পেছনে তাদের অবদান অপরিসীম।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ ক্রিকেটে একজন ক্রিকেটারের বিদায় কিংবা সংকট মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে বিসিবি বারবার ব্যর্থ হয়েছে। তা আরও প্রকট হয়ে উঠে মাশরাফি, তামিম, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক এবং সাকিবের নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
মাশরাফি বিন মর্তুজা: নেতৃত্ব ও বিদায় বিতর্কমাশরাফি বিন মর্তুজা বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হিসেবে পরিচিত। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করে। ২০১৫ বিশ্বকাপ, ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, এবং ২০১৯ বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে দল উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স দেখায়।
তবে তার বিদায় নিয়ে বিসিবি যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়, তা একপ্রকার দুঃখজনক। ২০১৭ সালে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের কোচিংয়ের সময় থেকেই টি-টোয়েন্টি থেকে তার বিদায়ের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। মাশরাফি নিজে অবসর নিতে চাননি, কিন্তু হাথুরুসিংহে এবং বোর্ড তাকে এমনভাবে চাপের মুখে ফেলে যে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি সিরিজের পর অবসর নিতে বাধ্য হন। তার ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকেও তাকে বিদায় জানানো হয় খুবই নীরবে। শেষ পর্যন্ত মাশরাফিকে একপ্রকার “জোরপূর্বক” দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সাকিব আল হাসান: নেতৃত্ব, নিষেধাজ্ঞা, ও বোর্ডের আচরণসাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অলরাউন্ডার এবং বিশ্ব ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল তারকা। তবে তার সঙ্গে বোর্ডের সম্পর্ক সবসময় মসৃণ ছিল না। ২০১৯ সালে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার সময় বোর্ড তার পাশে থাকার কথা বললেও কার্যত সাকিব নিজ উদ্যোগে সব সামলে নেন।
তাছাড়া সাকিবের অধিনায়কত্ব নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কখনো তার নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে, আবার কখনো দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে তামিমের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব এবং বিশ্বকাপের সময়কার পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট করে দেয় যে, বোর্ডের ভেতরে কোচ, খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতা করার সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই।
তামিম ইকবাল: ইগো ও অবসরের দ্বন্দ্বতামিম ইকবালের ক্যারিয়ারও নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয়ের মতো সাফল্য পায়। কিন্তু ইনজুরি ও ফিটনেস সমস্যার কারণে তাকে নিয়ে বোর্ডের সন্দেহ ছিল।
২০২৩ সালের বিশ্বকাপের আগে বিসিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখা হলেও প্রথম ম্যাচে না খেলার পরামর্শ দিয়ে এবং ব্যাটিং পজিশন পরিবর্তনের কথা বলে বোর্ড তাকে একপ্রকার হতাশ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় তামিম বিশ্বকাপের আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। যদিও পরে তিনি ফিরে আসেন, তবে ততদিনে বোর্ড ও তামিমের সম্পর্কের ফাটল স্পষ্ট হয়ে যায়।
মুশফিকুর রহিম: ফরম্যাট থেকে জোরপূর্বক বিদায়মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। কিন্তু ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি থেকে তার অবসর নেওয়ার পেছনে বোর্ডের চাপ ও কোচের ভূমিকা ছিল। মুশফিক নিজে কখনো খোলাসা করে কিছু বলেননি, তবে বোর্ডের আচরণে তার অভিমান ছিল স্পষ্ট।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ: দল থেকে বাদ পড়ার ইস্যুমাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, যিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ফিনিশার এবং একজন সফল অধিনায়ক, তাকে নিয়েও বোর্ডের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ। ২০২২ সালের এশিয়া কাপের আগে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়, যা নিয়ে অনেক বিতর্ক ওঠে। তাকে সঠিকভাবে বিদায় দেওয়ার কোনো উদ্যোগ বোর্ড নেয়নি।
তামিম-সাকিব দ্বন্দ্ব: বোর্ডের উদাসীনতাতামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। তামিমের অবসর এবং বিশ্বকাপ স্কোয়াড নিয়ে বোর্ডের সিদ্ধান্তহীনতা এই দ্বন্দ্বকে আরও উসকে দেয়। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, বোর্ড সভাপতি পাপন, এবং নির্বাচক প্যানেলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল পরিষ্কার। তাদের এই দ্বন্দ্বের কারণে দল বিশ্বকাপে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয় এবং এর প্রভাব মাঠের পারফরম্যান্সেও পড়ে।
বোর্ডের দায়িত্বহীনতা এবং সমাধান
উপরে বর্ণিত ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, বিসিবি কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ইগো এবং পরিকল্পনার অভাব বারবার দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বোর্ডের উচিত ছিল:
খেলোয়াড়দের বিদায় সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা।
দলীয় সংকট সমাধানে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেওয়া।
দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
দলীয় সমন্বয় এবং গ্রুপিং এড়ানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং খেলোয়াড়দের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হতো, তবে এসব ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।
Leave a Reply