আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও উদ্ভাবক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রতিটি সকাল শুরু করতেন কোনো জাঁকজমকপূর্ণ কাজে নয়,একটি সাদা কাগজে মাত্র ছয়টি শব্দ লিখে: “আজ কী ভালো কাজ আমি করতে পারি?” তখন তাঁর বয়স মাত্র চব্বিশ, ফিলাডেলফিয়ার এক স্যাঁতসেঁতে গলিতে একটি ছাপাখানা চালাতেন। তবু প্রতিদিন মেশিন চালুর আগে এই নিরব প্রশ্ন করতেন নিজেকে।
এই অভ্যাসটি ছিল তাঁর দীর্ঘ জীবনের এক অমূল্য রুটিন—দিন যত ব্যস্তই হোক, এই একরত্তি প্রশ্ন কখনও বদলায়নি। কারণ, ফ্রাঙ্কলিন জানতেন, কোনো রুটিনের আসল শক্তি তার জাঁকজমক নয়—বরং এটি আমাদের মন ও মনোযোগকে কোন দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।
আজ আমাদের সকালটা শুরু হয় একেবারে ভিন্ন এক কোলাহলে,মোবাইলের স্ক্রিনে নোটিফিকেশন, রাতের ঘটে যাওয়া খবর, কিংবা হঠাৎ মনে পড়া কোনো দায়িত্ব। কিন্তু মূল নীতিটা এখনো একই: দিনের প্রথম একটি মিনিটই বাকি হাজার মিনিটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
নিচে দেওয়া অভ্যাসগুলো একেবারে সহজ, নিখুঁত, এবং বাস্তব। এগুলোতে নেই কোনো অ্যাপ, কোনো দামি যন্ত্র, কিংবা কোনো কঠিন দর্শন-শুধু কিছু ছোট্ট অভ্যাস, যেগুলো দিন শুরুর আগেই আপনার জীবনের নিয়ন্ত্রণটা ফিরিয়ে এনে দিতে পারে। এগুলোর কোনো কিছুই একান্তভাবে নতুন নয়,দর্শন ও মনস্তত্ত্বের ইতিহাস থেকে নেওয়া বহুপ্রমাণিত অভ্যাস এগুলো।
১. ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই কাগজে লিখুন এক লাইনের কৃতজ্ঞতা
মোবাইলের স্ক্রিন চালু হওয়ার আগেই বিছানার পাশে রাখা নোটবুকে একটি মাত্র বাক্যে লিখে ফেলুন, আজ আপনি কোন একটি বিষয় নিয়ে কৃতজ্ঞ। যখন জায়গা থাকে মাত্র একটি লাইনের, তখন লেখাটিও হয় মনোযোগী ও আন্তরিক। কিছুদিনের মধ্যেই এই নোটবুকটি প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে।ভালো জিনিস আপনার জীবনে আগেও ছিল, এখনও আছে। ফলে, অভাবের মানসিকতা থেকে আপনি ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
২. এক গ্লাস পানি খেতে খেতে উচ্চস্বরে বলুন,দেয়ালের বাইরে আপনি কী দেখছেন
রাতেই পানির গ্লাসটি তৈরি করে রাখুন। সকালে উঠে সেটি হাতে নিয়ে জানালার দিকে তাকান বা বাইরে বের হন। এরপর চোখে পড়া তিনটি জিনিস উচ্চস্বরে বলুন: যেমন, “মেঘ পূর্ব দিকে যাচ্ছে”, “রাস্তার পাশে কুকুর হেঁটে যাচ্ছে”, বা “ছাদের উপর একটি অ্যান্টেনা”। এভাবে আপনি আপনার ভেতরের চিন্তা থেকে বেরিয়ে বাস্তব দুনিয়ায় সংযুক্ত হতে পারবেন।
৩. তিন মিনিটের ‘মুড স্ট্রেচ’ করুন,যেভাবে আপনার শরীর চায়
রুটিনমাফিক এক্সারসাইজ নয়,শুধু নিজের শরীরের কথা শুনে তিন মিনিট হালকা নড়াচড়া করুন: হাত তোলা, কোমর মোচড়ানো, হালকা লাফ যেভাবে আপনার শরীর চায়। এটা ঘুমের পর হওয়া জড়তা দূর করে এবং আপনার মনেও এক ধরনের ইতিবাচক অনুভূতি জাগায়।
৪. আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে করিয়ে দিন: আপনি আজ কীভাবে নিজেকে পরিচালনা করবেন
একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য বলুন,যেমন, “আমি ধৈর্য ধরে সমস্যার সমাধান করি”, বা “আমি যা শুরু করি, তা শেষ করি।” নিজের কণ্ঠস্বর শুনলে আপনি নিজেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ অনুভব জাগে।
৫. এমন একটি বই থেকে ১০ লাইন পড়ুন, যেটি কমপক্ষে ১০০ বছর পুরোনো
খাবার টেবিলে একটি পাতলা ক্লাসিক বই রাখুন। যেখান থেকেই খুলুন, পড়ুন মাত্র ১০ লাইন। ইতিহাসের দূরত্ব ও পরিপ্রেক্ষিত আপনার মনকে সজাগ করে, যা আজকের খবর বা সোশ্যাল মিডিয়া দিতে পারে না।
৬. প্রতিদিন একটিমাত্র ছোট ঝামেলা দূর করুন
যেমন, টেবিলের একটি ঢিলা পেরেক টাইট করা, মোবাইলের একটি অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ মুছে ফেলা। এই ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো সমাধান করে আপনি নিজের নিয়ন্ত্রণবোধ জাগিয়ে তুলতে পারেন।
৭. চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন, যতক্ষণ না দিনের একটি মূল প্রশ্ন মাথায় আসে
নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: “আজকের দিনে একটিমাত্র কাজ করলে আমি সন্তুষ্ট হব?” যখন প্রশ্নটি স্পষ্ট হবে, সেটি লিখে ফেলুন। দিনের অন্য কাজগুলোর গুরুত্ব তখন এই এক প্রশ্নের আলোকে বিচার করতে পারবেন।
৮. তিনটি কাজের “না” লিখে দিন যা আজ করবেন না
যেমন, “সকাল ১০টা পর্যন্ত ইমেইল নয়”, “আজ কোনো নিউজফিড দেখব না”, বা “অপ্রয়োজনীয় মিটিং এড়িয়ে চলব”। একটি স্টিকি নোটে লিখে রাখুন। এটি আপনার সময়কে বাঁচাবে এবং আপনাকে আরও ফোকাসড রাখবে।
৯. প্রতিদিন মাত্র ৬০ সেকেন্ড বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির আলো, হাওয়া, শব্দ গ্রহণ করুন
ফোন ছাড়া বাইরে বের হয়ে সূর্যের আলো চোখে লাগতে দিন, বাতাস অনুভব করুন, পাখির ডাক শুনুন। এই মুহূর্তটি আপনার দেহঘড়িকে জাগিয়ে তুলবে এবং মনে করিয়ে দেবে, আপনি প্রকৃতিরই অংশ।
Leave a Reply