প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। নির্বাচিত একটি লেখা পড়ুন এখানে।
মাকে নিয়ে একবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। পড়ন্ত বিকেল। সৈকতে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। বিশাল জলরাশির ওপারে সূর্য ডুবছে। অপলক দৃষ্টিতে সূর্যাস্তের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছেন মা। সেই সময়, সেই দিনটা আমার কাছে আজও অমলিন। কি যে ভালো লাগছিল সেই মুহূর্ত, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
আমার মা সালেহা বেগমের বয়স এখন ৭০। মাকে নানাবাড়িতে সবাই আদর করে ডাকে ‘সালু’। নানা ফজলুর রহমান প্রধানের চার মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে তিনি সবার ছোট, সবার আদরের।
আমার দাদার বাবা হাজি জব্বার আলী ছিলেন কুমিল্লার দাউদকান্দির ঐতিহ্যবাহী এক মুসলিম পরিবারের সদস্য। নামডাকওয়ালা জব্বার আলীর ছোট নাতি আমার বাবা আবদুল গণি। তাই মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে নানাবাড়ির কেউই দ্বিমত করেননি। বিয়েটা হয়েছিল বেশ ধুমধাম করে।
বাবা ছিলেন সেই সময়ের এন্ট্রাস (মেট্রিক) পাস। তবে বোহেমিয়ান প্রকৃতির। আজ এখানে, তো কাল অন্য কোথাও। ধনী পরিবারে বিয়ে করে বাবা নাকি জগৎ-সংসার নিয়ে বিরাট বিপত্তিতে পড়েছিলেন। প্রায় সময় মাকে নানাবাড়ির লোকজন নাইয়র নিয়ে আটকে রাখতেন। এর কারণ, বাবার ছন্নছাড়া এলোমেলো জীবন। মাকে আনতে গিয়ে বাবা যখন বিফল হতেন, তখন নাকি নানাবাড়ির আশপাশে হাওর-বিলে নৌকা থামিয়ে রাতবিরাতে কাওয়ালি ও ভাটিয়ালি গাইতেন। মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করতেন। এরপর মা আবার বাবার কষ্টের সঙ্গী হয়ে ফিরতেন।
একসময় সংসার বড় হতে থাকে। কিন্তু বাবার জীবনে স্থিতি আসে না। পারিবারের আর্থিক সংকট দেখা দেয়।
বাবা একবার খাগড়াছড়ি গিয়ে জমি কিনে সেখানে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দাদা ও নানাবাড়ির লোকজনের আপত্তিতে যেতে পারেননি। এরপর কুমিল্লার সহায়-সম্পদ বিক্রি করে দেন। পরিবার–পরিজন নিয়ে চলে যান সুনামগঞ্জ। সেটা ১৯৮১ সাল।
নতুন জায়গা। বাবা অনেক জমি কিনেছিলেন তখন। কিন্তু অনেকেই বাবার সঙ্গে প্রতারণা করল। কেউ জমি দখল করল, কেউ টাকা নিয়ে মেরে দিল, আবার কেউ কেউ সুনামগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করার ভয় দেখাল। মায়ের সাজানো-গোছানো সোনার সংসার বাবার কারণে তছনছ হয়ে গেল। পরিবারে নেমে এল সীমাহীন কষ্ট।
আট ভাই, এক বোন নিয়ে আমাদের বিশাল পরিবার। চরম সংকট চলছে। এর মধ্যে নানাবাড়ি থেকে চিঠির পর চিঠি আসছে, আবার কুমিল্লায় ফেরার তাগাদা। কিন্তু মা আর রাজি হন না।
মাকে নানাবাড়িতে কখনোই অভাব-অনটন আর কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। সুনামগঞ্জে আসার পর প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। সংসার চালানো মায়ের জন্য বিরাট কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। আমি যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই মাকে সংসার নিয়ে সংগ্রাম আর কষ্ট করতে দেখেছি।
আমাদের পরিবার ছিল কৃষিনির্ভর। কৃষি থেকে আয় হতো অতি সামান্য। বাধ্য হয়ে বড় ভাইয়েরা অন্যের জমি বর্গা চাষ করতেন। দিনমজুরি করে যা পেতেন, সেই টাকা তুলে দিতেন মায়ের হাতে।
আমাদের মুখে দিনে দুবেলা খাবার তুলে দেওয়াটাও যে মায়ের জন্য কত কষ্টের ছিল, সেসব মনে পড়লে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কত রাত, কত দিন আমাদের পাতে খাবার তুলে দিতে না পেরে মাকে নীরবে-নিভৃতে কাঁদতে দেখেছি, তার হিসাব নেই।
সংসারের শত টানাপোড়েন আর বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্যেও আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, লেখাপড়া করতে হবে। আমরা দিনে জমিতে কাজ করতাম আর রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে সব ভাইবোন পড়তে বসতাম। মা সারা দিন সংসারের ঘানি টেনে রাতে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে নজর রাখতেন আমাদের পড়াশোনার প্রতি।
আমার বড় চার ভাই অভাব-অনটনে বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি। আমরা ছোট চার ভাই এবং একমাত্র বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমি চিকিৎসক হয়েছি। এক ভাই প্রকৌশলী, আছেন অস্ট্রেলিয়ায়। আরেক ভাই নিরীক্ষক ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সরকারি চাকরিজীবী। এক ভাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। একমাত্র বোন সিলেট এমসি কলেজে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। অন্য ভাইয়েরা কৃষিকাজ ও ব্যবসা করছেন।
আমাদের যা কিছু অর্জন, সফলতা; তার পেছনে আমাদের মমতাময়ী মায়ের সংগ্রাম জড়িয়ে আছে।
বাবা প্রয়াত হয়েছেন প্রায় ২২ বছর। এখনো আমাদের ছায়া, মায়া দিয়ে যাচ্ছেন মা।
লেখক: চিকিৎসক, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
Leave a Reply